বিসিএস ও নির্মম বাস্তবতা

By | 12/11/2022
bcs final result

বাস্তবতা হচ্ছে বেশিরভাগই ননক্যাডার পাবেন তাই ভেঙে পড়লে চলবে না। বিসিএস ম্যারাথন, স্প্রিন্ট না। আপনাকে বিশ্বকাপ একবার জিতলেই হবে বারবার না। শচিন টেন্ডুলকার, ম্যারাডোনারা প্রথম বারেই বিশ্বকাপ জেতেননি। আর ক্যাডার মানে বিশ্বকাপ সেটা বলতেও আমি নারাজ। কেউ ক্যাডার হয়ে চরম অসন্তুষ্ট আছেন কেউ হয়ত প্রাইভেট চাকরি করেও তার চেয়ে বেশি সুখী আছেন। আজ আমরা বেকার তাই মনে হচ্ছে একটি সরকারি চাকরি জীবনের সকল গ্লানি মুছে দিবে, সব কিছু হাতের মুঠে নিয়ে আসবে। মোটেও সেরকম না।

চাকরি করে আমি, আপনি বড়জোর সচিব হতে পারব। ভেবে দেখুন সচিব মহোদয়ের কি মন্ত্রী হতে ইচ্ছা করে না? মন্ত্রী মহোদয়ের কি প্রধানমন্ত্রী হতে ইচ্ছা করে না? উনার কি আরও বড়, শক্তিশালী দেশের প্রধান হতে ইচ্ছা করে না? আমেরিকা, রাশিয়ার প্রেসিডেন্টরাও হয়ত “সর্বশক্তিমান” হতে চান যেন যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন। আপনার ইচ্ছা, চাহিদার ওপরই আপনার জীবনের সন্তুষ্টি নিহিত। ভুলে যাবেন না সবারই সীমাবধ্যতা আছে। বৈষয়িক প্রাপ্তি কখনও মানুষকে চরম সন্তুষ্টি এনে দিতে পারে না। বড়জোর সাময়িক শান্তি দিতে পারে। তাই একটি চাকরি কখনই আমাদের চরম সন্তুষ্টি এনে দিতে পারে না। এটা সব মুশকিলের আসান এমন কিছু না। ক্যাডারদের দেখে হয়ত ভাবছেন উনি চিরসুখী, সুখের সাগরে ভাসছেন, উড্ডয়ন করছেন নিরন্তর। বিষয়টা মোটেই তেমন না। কাছে গিয়ে দেখলে ধারণা বদলে যেতে পারে। বিসিএস লেজেন্ড সুশান্ত পালের ২৩.৫.২০২১ তারিখের স্ট্যাটাস  “চাকরিজীবী হওয়াটা সহজ নয়—ঘরেও জিম্মি হয়ে থাকতে হয়, অফিসেও জিম্মি হয়ে থাকতে হয়। ব্যবসাই ভালো!” কী বুঝলেন? মূলত, অল্পতে যারা তুষ্ট, তারাই প্রকৃত সুখী।

আসলে মানুষের জীবনটা অনেক ব্যাপক; একটি চাকরি তার অংশবিশেষ মাত্র। সম্পূর্ণ জীবনকে সেটা কখনই প্রভাবিত করতে পারে না। কথাগুলো আমার অভিজ্ঞতার আলোকে বলা। আমিও একসময় “বিসিএস সাইকো” ছিলাম কিন্তু সময়ের সাথে আমার মাঝে অনেক পরিবর্তন এসেছে। ৩৭তম ভাইভা পাস করেছি কিন্তু ৩৮তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষায় ফেল করে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিলাম। কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না। তারপর আমার জীবনে কিছু আমূল পরিবর্তন আসে। তারপর থেকে আমি অনেক পজিটিভ চিন্তা করা শিখেছি। পরে বুঝতে পারি রিটেনে ফেল না করলে এই “অমূল্য শিক্ষাটা” আমাকে কেউ শেখাতে পারতেন না। সেই হিসাবে ভালই হয়েছিল : আলহামদুলিল্লাহ। আমি আশাপাশে তাকিয়ে দেখলাম আমি ফেল করলেও আমার পরিচিত ৪-৫ জন পাস করেছেন যাদের প্রত্যকের বাবা রিটেনের রেজাল্ট দেবার আগেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। সেই হিসাবে আমি অনেক ভাগ্যবান। পৃথিবীর কোন ক্ষমতা, পদ বা কোন কিছুর বিনিময়ে আমি আমার পবিরারের সদস্যদের বিদায় মেনে নিতে পারব না। আমি মনে করি, বিশ্বাস করি আপনিও আমার মত। আমার মনোবল এখন অনেক দৃঢ় হয়েছে। তাই বলছি যারা ক্যাডার বা ননক্যাডার হতে পারবেন না, তারা জীবনের শেষ এটা কখনই ভাববেন না। পৃথিবীতে কোটি কোটি মানুষ না খেয়ে আছেন, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ছেলে মারা গিয়েছে, সিলভেস্টার স্ট্যালোন মানে র‍্যাম্বোর/রকির ছেলে মারা গিয়েছে, শাহরুখ খানের প্রতিষ্ঠা তার বাবা মা কেউ দেখে যেতে পারেননি, সম্প্রতি বিল গেটসের সংসার চুরমার হয়ে গেছে, সালমান খান তো কোনো নারীকেই পার্ফেক্ট মনে করছেন না, আর দুনিয়া কাঁপানো মেসিতো খুব সম্ভবত আজীবন আক্ষেপ করবেন বিশ্বকাপ না জেতার কারণে যেই কাপ শুধু আর্থিক দিক বিবেচনা করলে তিনি কতগুলি কিনতে পারবেন তিনি নিজেই জানেন না। আমি যা বোঝাতে চাচ্ছি সেটা হচ্ছে দূর থেকে অনেক কিছুই চাঁদের মত সুন্দর দেখা যায় কিন্তু কাছে গেলে বোঝা যায় শুরু গর্ত আর গর্ত। জীবনে অপ্রাপ্তি থাকবেই, আপনি ননক্যাডার বা সমাজের চোখে অজনপ্রিয় ক্যাডার পেয়েছেন কিন্তু আপনার বন্ধু যাকে আপনি আপনার মেধার সাথে তুলনা করতে রাজি নন, তিনি ক্যাডার বা সমাজের চোখে জনপ্রিয় ক্যাডার হয়ে যাবেন—এটাই জীবন। সব কিছু আমাদের হিসাব অনুযায়ী হবে না। হলে দক্ষিণ আফ্রিকা অন্তত একবার ক্রিকেট বিশ্বকাপ জিতত।

হয়ত ভাবছেন আমি নেগেটিভ টাইপ মানুষ। যে যুদ্ধে বেশিরভাগ কাঙ্ক্ষিত ফল পাবেন না, সেখানে শুধু সফলতার সুফল দেখানো আর ব্যর্থতাকে বাদ রাখা অনুচিত বলেই আমি মনে করি, বিশ্বাস করি। আপনাকে সব কিছুর জন্যই প্রস্তুত থাকতে হবে। পরিশ্রম করলেই যদি ক্যাডার হওয়া যেত তাহলে ঘরে ঘরে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, উসাইন বোল্ট থাকত। আপনার পরিশ্রম, মেধা ভাগ্যের কাছে হার মানতে বাধ্য হতে পারে। যদিও সফল হলে কেউ ভাগ্যকে ক্রেডিট দিতে চান না; মেধা আর পরিশ্রমকেই সব নিয়ামক বলে থাকেন। তবে কেন যেন মেসি প্রতিটি গোল করার পর সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ দিতে ভুলে যান না; বড় বড় ক্রিকেটারেরা সেঞ্চুরি করে আকাশে পানে চেয়ে দেখেন।

এত খারাপ পরীক্ষায় দিয়েও কীভাবে পাস করলাম? এটা বলতেও শুনেছি; পরে তিনি ক্যাডারও হয়েছেন। রিটেন খারাপ হয়েছে তাই ভাইভায় এটেন্ড করবে না এমন ব্যক্তিকেও ক্যাডার হতে দেখেছি; প্রায় ৪০ মিনিট পর পরীক্ষার হলে উপস্থিত হয়েছে এমন ব্যক্তিকেও প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হতে দেখেছি। হয়ত বিশ্বাস করছেন না; আমি জানি। আমি যেটা বোঝাতে চাচ্ছি সেটা হচ্ছে বিসিএস এমন একটা এক্সাম যেটাতে আপনার প্রত্যাশার বাইরে অনেক কিছুই হতে পারে। This is the ugly truth। আপনার পরিচিত সব ক্যাডাররা যেমন মেধাবী, তেমনি তাদের একই লেভেলের বন্ধুরাও ক্যাডার হতে না পারায় কি আজ অমেধাবী? । মূল কথা হচ্ছে আপনি আপনার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন, পেলে আলহামদুলিল্লাহ, না পেলেও আলহামদুলিল্লাহ এমন মনোভাব বজায় রাখবেন। অন্তরে peace অনুভব করবেন। আমাদের মানসিক শান্তি এনে দিতে পারে শুধু আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, জীবনদর্শন; কোন চাকরি নয় সেটা যদি আপনার ড্রিম জব হয় তবুও কারণ জীবনটা অনেক বিস্তৃত, ব্যাপক এবং বৈচিত্র্যময়। আমার কথাগুলো খারাপ লাগলে সরি। আমি আমার কয়েক বছরের অভিজ্ঞতা শেয়ার করলাম এই পোস্টের মাধ্যমে। আর কথা বাড়াচ্ছি না। আমার জন্য দোয়া করবেন কারণ আমার বিসিএসযুদ্ধ এবং জীবনযুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি। ৩০ পার হওয়া এই ব্যক্তিটির কাছে জীবনের প্রায় সব কিছুই এখনও too close, too far!

আল্লাহ হাফেজ।

শেয়ার করুন বন্ধুর সাথে

Leave a Reply

Your email address will not be published.